কুরআনের অনেকগুলো শ্রেষ্ঠত্বের মধ্যে অন্যতম হলো এর ইজায বা সংক্ষিপ্ততা। ছোট্ট একটি পাত্রে আস্ত সমুদ্র রেখে দেওয়ার মতো ব্যাপার। কুরআনের যে বিষয়গুলো আমাকে আনন্দ দেয়, তিলাওয়াতকালে বিমোহিত করে, তার মধ্যে এটি হলো একটি। অর্থের দিকে খেয়াল করে পড়তে পড়তে দেখি কুরআন না বলেও বহুত কথা বলে ফেলছে। চুপিচুপি অনেক বিষয়ই তুলে ধরছে।
না বলেও বলে দেওয়া হলো কুরআনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ভাবনার গভীরতা যতো বিস্তৃত হবে, এই বৈশিষ্ট্য ততোবেশি জোরালোভাবে আপনার সামনে উপস্থিত হবে। আপনি দেখবেন, কুরআন বলছে ‘অ’ আর বুঝাচ্ছে অজগর থেকে শুরু করে আরও বহু কিছু। কুরআন বুঝলে আপনি এই মজাটা পাবেন।
কুরআনের ব্যাপারে আরবীতে খুব প্রসিদ্ধ একটি কথা আছে। তা হলো, ‘আলকুরআনু লা তানকযী আজাইবুহু’। কথাটার মানে হলো, কুরআনের বিস্ময় কখনও শেষ হওয়ার নয়। কুরআন নিয়ে যতো ভাববেন ততোই আপনার সামনে এর নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হবে। একই আয়াত থেকে দেখবেন প্রতিবারই আপনি নিত্য নতুন মর্ম উদ্ঘাটন করতে পারছেন। ভাবনার পালে যতো হাওয়া দিবেন, নতুন নতুন মর্মার্থ আবিষ্কার ততোদ্রুত সামনে অগ্রসর হতে থাকবে।
আমি একবার কুরআনের দাওয়াহ বিষয়ক একটি আয়াত নিয়ে ভাবা শুরু করেছিলাম। দেখলাম, যতো ভাবছি ততোই এর সম্প্রসারণ ঘটছে। গভীর থেকে গভীরে আমি তলিয়ে যাচ্ছি। একটা পর্যায়ে মনে হলো, ভালো করে ভাবলে হয়তো এই এক আয়াতেই দাওয়াতের পরিপূর্ণ কর্মপদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেলা সম্ভব হবে। আমি উঠেপড়ে লাগলাম এবং লাগাতার কয়েকদিন আয়াতটি নিয়ে ভাবতেই থাকলাম। দেখলাম যে, প্রতিবারই আমার সামনে নতুন নতুন বিষয় উন্মোচিত হচ্ছে। আমি দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে এই তাদাব্বুর অব্যাহত রাখলাম এবং আশ্চর্য ফলাফল পেলাম। এই বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ স্বতন্ত্র কোন লেখায় তুলে ধরবো ইনশাআল্লাহ।
এখন এই ধরনের একটি দৃষ্টান্ত পেশ করবো। ভেঙ্গেভেঙ্গে দেখাবো, কিভাবে কুরআন না বলেও বহু কথা বলে। এই বলাটা অবশ্য চিন্তাশীল পাঠকদের জন্য। যারা কুরআন নিয়ে তাদাব্বুর করে। কুরআনের আয়াতগুলোকে ভাবনা-চিন্তার উর্বর ভূমি থেকে ঘুরিয়ে আনে। অন্যথায় যদি কেউ কুরআনকে মন্ত্রের মতো পড়ে যায় তবে সে তিলাওয়াতের সওয়াব হয়তো পেয়ে যাবে; কিন্তু কুরআনের শিক্ষাকে জানা ও উপদেশগুলো নিয়ে ভাবার যে নেকি, তা থেকে বঞ্চিত হবে। আরবরা বলে, ‘ইযা নাকাহাল হিফযুল ফিকরা, উলিদাতিল আজাইব’। যখন মুখস্তবিদ্যার সাথে ভাবনা-চিন্তার বিয়ে হয় তখন তার ঔরসে আজিব কিসিমের সব জিনিসের জন্ম হয়।
চলুন, দেখে আসি কিভাবে হিফজের সাথে ফিকরের বিয়ে হবার পর তাদের ঔরসে আসে নতুন নতুন সব ফুটফুটে সন্তান। যাদের দেখলেই চোখ জুড়ায়। যাদের কথা ভাবলেই হৃদয় শীতল হয়। তাফসীরের কিতাবগুলোতে আপনি এমন হাজার হাজার সন্তানের দেখা পাবেন। যেসব তাফসীর কেবলই রেওয়াতভিত্তিক নয়, বরং তাতে তাফসীরকারকের নিজস্ব ভাবনাগুলোও সন্নিবেশিত হয়েছে সেগুলো এক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এটি কুরআনের সৌন্দর্যকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। এর অর্থ আর মর্মতে আনে অসাধারণ ব্যাপ্তি।
সূরা নাহলের একটি আয়াত দিয়েই শুরু করা যাক। আল্লাহ তাআলা বলছেন,
وَاللَّهُ أَخْرَجَكُم مِّنۢ بُطُونِ أُمَّهٰتِكُمْ لَا تَعْلَمُونَ شَيْـًٔا وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصٰرَ وَالْأَفْـِٔدَةَ ۙ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
“আর আল্লাহ তোমাদেরকে বের করেছেন, তোমাদের মাতৃগর্ভ থেকে এমতাবস্থায় যে, তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন শ্রবণশক্তি, চক্ষু ও অন্তর। যাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় কর।” (নাহল :৭৮)
এই আয়াতকে আমরা দুইটি ভাগে ভাগ করতে পারি।
ক. আমাদের অজ্ঞতা ও জ্ঞানহীনতার অবস্থা। মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় আমরা কেউ-ই জ্ঞানের বহর সঙ্গে করে আসিনি। প্রত্যেকেই তখন ছিলাম অজ্ঞ। আমাদের মস্তিষ্ক ছিলো জাহালতে পূর্ণ। পুরো পৃথিবীর কোন একটা বস্তুর নামও আমাদের জানা ছিলো না। কোন কিছুর সাথেই আমাদের পরিচয় ছিলো না। সবকিছুই তখন আমাদের কাছে নতুন। যা দেখি, যা শুনি সবই তখন অশ্রুতপূর্ব ও অদেখা বস্তু।
খ. তারপর শুরু হলো আমাদের জ্ঞানী হবার পালা। জাহালতের স্থলে ধীরেধীরে আমাদের মধ্যে তথ্যের সমাবেশ ঘটার কাল। আমাদের মস্তিষ্ক যতোবেশি শব্দ, শব্দের মধ্যে নিহিত মর্ম, বাক্য ও বাক্যের মধ্যে ভেসে বেড়ানো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলো ধারণ করতে লাগলো, আমরা ততোবেশি জাহালতের গণ্ডি ছাড়িয়ে জ্ঞানের আলোকিত ভুবনে প্রবেশ করা শুরু করলাম।
আয়াতের এই দ্বিতীয়াংশে অজ্ঞতার খোলস ছেড়ে আমাদের জ্ঞানার্জনের কথা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তো সাধারণ দৃষ্টিতে যদি আমরা আয়াতের অর্থের প্রতি লক্ষ্য করি, তবে এতোটুকুই কেবল দেখতে পাবো যে, আয়াতে আল্লাহ তাআলা বললেন, জন্মের সময় তোমরা কিছুই জানতে না। এবং তিনি তোমাদের জন্য দেহের এই এই অঙ্গ তৈরি করেছেন। সবশেষে বললেন, হতে পারে তোমরা শুকরিয়াগুজার বান্দা হবে।
এবার চলুন আমরা সাধারণ দৃষ্টির সীমানা পেরিয়ে আয়াতের আরেকটু গভীরে চলে যাই। তাদাব্বুরের চশমা পরে আয়াতটি দেখার চেষ্টা করি। তবেই এতে নতুন কিছু আবিষ্কারে সক্ষম হবো। দেখবো, কুরআন কিভাবে না বলেও কত্তো কথা বলে দিলো এই ছোট্ট কয়েকটি লাইনে। আমাদের সামনে কিভাবে তুলে ধরলো একটি বিশাল বড় জীবন-দর্শন। জ্ঞানার্জন ও তথ্য-আহরণের একটি অমূল্য নীতি। যা গ্রহণ করে নিলে আমরা হরহামেশা অনেক ফ্যাসাদের জালে আটকে পড়া থেকে বেঁচে যাবো। মুক্তি পাবো অনেক ভুল সিদ্ধান্তের গ্যাঁড়াকলে ফেঁসে যাওয়া থেকে। আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হবে একটি নতুন মহাসড়ক। যার মাধ্যমে আমরা খুঁজে পাবো সঠিকভাবে প্রত্যেকটি জিনিসকে মূল্যায়ন করার দিশা।
প্রিয় পাঠক, দ্বিতীয় অংশের এই বিষয়গুলো জানার আগে চলুন প্রথম অংশের উপর আরেকটু নজর বুলিয়ে নেই। এখানে দেখবো চমৎকার একটি জিনিস। তা হলো, কুরআন কিভাবে তার বর্ণনাশৈলীতে সূক্ষ্মতা রক্ষা করে থাকে।
কুরআন বলছে, “আর আল্লাহ তোমাদেরকে বের করেছেন, তোমাদের মাতৃগর্ভ থেকে এমতাবস্থায় যে, তোমরা কিছুই জানতে না।” এখানে ‘তোমরা কিছুই জানতে না’ বাক্যটি আরবী ব্যাকরণ অনুপাতে ‘হাল’ হয়েছে। যা কেবল জন্মগ্রহণের সময়কার অবস্থাকেই নির্দেশ করছে। জন্মগ্রহণ যখন শেষ, ঠিক তখনই এই অবস্থারও পরিসমাপ্তি ঘটে।
একটি বাচ্চা পৃথিবীর আলো-বাতাসের সংস্পর্শ পাওয়ার পর থেকেই একটু একটু করে পৃথিবী ও এর মধ্যকার বস্তুসকলকে চিনতে শুরু করে। চোখ মেলেই সে যা দেখে ওটাকে চিনে নেয়। তার মস্তিষ্কে তাকে গেঁথে নেয় ভালো করে। সেজন্যই দেখা যায় বাচ্চাকে প্রথমবার মায়ের স্তন চিনিয়ে দেওয়ার পর নতুন করে আর চেনাতে হয়না। সে নিজে নিজেই ক্ষুধা লাগলে মায়ের স্তনের তালাশে থাকে। কারণ সে বুঝে নিয়েছে ওখানেই তার পেটের ক্ষুধা নিবারণের বস্তু লুকিয়ে আছে। তো ‘কোন কিছুই জানতে না’ এই কথাটা ঠিক ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়কাল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। তারপর তো একটা-দুইটা করে জ্ঞান বাচ্চার মস্তিষ্কে জমা হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। তখন আর ‘কোন কিছুই জানতে না’ কথাটা ঠিক থাকে না।
কুরআন এখানে ব্যাকরণগতভাবে এমন একটা শৈলী গ্রহণ করেছে যে, এতো সূক্ষ্ম ভুল হওয়ারও ফাঁক রাখেনি। যদিও সামান্য কিছু জানাকে ‘না-জানা’ বলেই ধরা হয়, তবুও কুরআন সেই পথে হাঁটতে চায়নি। (কারো মাথায় প্রশ্ন আসতে পারে, মায়ের পেটে থাকা অবস্থায়ও তো বাচ্চা মায়ের পেট-জগতের অনেক কিছু জানতো। ওই জগতের সাথে তার জ্ঞানগত সম্পর্ক ছিলো। এমন প্রশ্ন অমূলক এই কারণে যে, আমরা দুনিয়ার জগত নিয়ে আলাপ করছি। মায়ের পেটকে দুনিয়ার জগত হিসেবে গণ্য করা হয় না। অন্যথায় এভাবে ভাবতে গেলো তো বলতে হয়, মায়ের পেটে অস্তিত্বে আসার আগে রূহের জগতেও বাচ্চার অস্তিত্ব ছিলো। সেখানে আল্লাহর সাথে কথোপকথন ও জিজ্ঞাসাবাদের বর্ণনা কুরআনেও এসেছে। আল্লাহ জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমি কি তোমাদের রব নই?’ তখন সকল রূহ উত্তর দিয়েছিলো, ‘কেন নয়? অবশ্যই আপনি আমাদের রব। তারমানে রূহের জ্ঞান ছিলো। সেই জ্ঞানের সহায়তা নিয়েই তারা আল্লাহর জিজ্ঞাসার জবাব দিয়েছিলো।)
আসুন, এবার আমরা আয়াতের দ্বিতীয়াংশে ও আমাদেন মূল আলোচ্য বিষয়ে ফিরে যাই। তাদাব্বুরের সরোবরে একটুখানি ডুব দেই। দেখি, আমাদের জন্য সরোবরের তলদেশে অপেক্ষা করছে কী ধরনের মনি-মানিক্য।
দ্বিতীয়াংশে আমাদের জন্য কয়েকটি অঙ্গ সৃষ্টির কথা আল্লাহ তাআলা বললেন। সেই অঙ্গগুলো হলো যথাক্রমে :
* কান বা শ্রবণেন্দ্রিয়।
* চক্ষু বা দৃষ্টিশক্তি
* অন্তকরণ বা হৃদয়।
প্রশ্ন হলো, আল্লাহ তো আমাদের জন্য আরও বহু অঙ্গ সৃষ্টি করেছেন। কথা বলার জন্য মুখ, ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য নাক, ধরার জন্য হাত, চলার জন্য পা, স্মৃতিরক্ষার জন্য মস্তিষ্ক ইত্যাদি আরও নানাবিধ অঙ্গ। সেগুলোর কথা না বলে আল্লাহ তাআলে এখানে কেন মাত্র তিনটি অঙ্গের কথা বললেন? মস্তিষ্ক -যা কিনা আমাদের দেহের অন্যসব অঙ্গকে পরিচালিত করে- তার কথাও উল্লেখিত হয়নি। তারমানে নিশ্চয়ই এখানে কোন রহস্য আছে। আল্লাহ তো হাকীম। তার কোন কাজই হেকমতমুক্ত নয়।
জি পাঠক, আপনি ঠিকই ধরতে পেরেছেন। এখানেই হলো মূল রহস্য। সেই রহস্য উদ্ঘাটন করতে হলে আমাদেরকে দুইটা জিনিস ভালোমতন দেখতে হবে। প্রথমত উল্লেখিত অঙ্গগুলো কি কি। দ্বিতীয়ত সেগুলো উল্লেখ করার ধারাবাহিকতা কি। তারপর এই দুই বিষয়ের সাথে জ্ঞানার্জনের সম্পর্কসূত্র আবিষ্কার করতে হবে। এ-টুকুন কাজ করতে পারলেই আমরা অবধারিতভাবে তৃতীয় আরেকটি বিষয় অনায়াসে উদ্ঘাটন করে ফেলতে পারবো ইনশাআল্লাহ।
তাহলে শুরু করা যাক।
উল্লেখিত অঙ্গগুলোর নাম ও ধারাবাহিকতা প্রসঙ্গক্রমে আমরা আগেই জেনে নিয়েছি। তবুও মস্তিষ্ককে শাণ দিতে আরেকবার এর উপর চোখ বুলানো যাক-
“তিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন কান বা শ্রবণশক্তি, চক্ষু বা দৃষ্টিশক্তি ও অন্তর।”
আমরা জ্ঞানার্জন করি শুনে শুনে। হতে পারে সেটা শিক্ষালয়ের শিক্ষকের কথা শুনে কিংবা দরসগাহে উস্তাদের কথা শুনে অথবা ওয়াজের মঞ্চ, মসজিদের মিম্বার থেকে বক্তা-ইমামের কথা শুনে। এমন বিভিন্ন লোকদের থেকে শুনে শুনে আমরা জ্ঞানার্জন করি।
আমাদের জ্ঞানার্জনের আরেকটি মাধ্যম হলো চোখে দেখা। কে কি করছে, কিভাবে করছে সেগুলো দেখে আমরা শিখি। বিশেষত হাতেনাতে যেসব বিষয় শিক্ষা দেওয়া হয় সেগুলো আমরা দেখেদেখেই রপ্ত করি। বইপুস্তক পাঠকরে জ্ঞানার্জন করাও এর অন্তর্গত। কারণ চোখ দিয়ে দেখে দেখেই আমরা বইপাঠ করি। সেখান থেকে যা শেখার শিখি।
শোনা বা দেখা যেটাই হোক না কেন তাকে ফিল্টার করার জন্য আছে অন্তর। অন্তর দিয়ে অনুধাবন ও উপলব্ধি করে আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছি যে, কোন একটি বিষয় ঠিক কি বেঠিক। তারপর অবস্থা অনুপাতে ব্যবস্থা নিয়ে সেটাকে মস্তিষ্কের গোডাউনে জমা রাখি বা অপ্রয়োজনীয় ভেবে ফেলে দেই।
এই হলো জ্ঞানার্জন ও পরবর্তীতে তাকে সংরক্ষণের ধারাক্রম। অজ্ঞতাপূর্ণ অবস্থায় আমাদের জন্মগ্রহণের পর শরীরের এই তিনটি প্রত্যঙ্গ উল্লেখের ভেতর দিয়ে ইঙ্গিত করা হলো, কিভাবে অজ্ঞতাকে ঝেটিয়ে বিদায় করে জ্ঞানের শুভাগমন ঘটে আমাদের মধ্যে।
জ্ঞানার্জনের সাথে এই অঙ্গগুলোর প্রত্যক্ষ সম্পর্কের ব্যাপারটা বুঝার পর এর চলুন আমরা আরেকদিকে যাই। কুরআনের এই ধারাক্রম আমাদেরকে জীবন চলার পথে বড় একটি মূলনীতি শিক্ষা দিচ্ছে। তা হলো, শোনা কথায় কান দিতে নাই। একটা গুজব শুনেই হুট করে তা বিশ্বাস করে ফেলতে নাই। চিলে কান নিয়েছে শুনে চিলের পেছন পেছন ছুটতে থাকা অনুচিত। বরং শোনার পর আপনি চাক্ষুস তা যাচাইয়ের চেষ্টা করুন। অনেক সময় চাক্ষুষ যাচাইয়ে যে ফলাফল বের হয়ে আসে তা-ও ভুল বোঝার শঙ্কা থেকে মুক্ত থাকে না। তখন আপনাকে ব্যবহার করতে হবে অন্তর নামক তৃতীয় মাধ্যমটি। কানে যা শুনলেন, চোখে যা দেখলেন সেগুলোকে অন্তর নামক ফিল্টার দিয়ে বিশ্লেষণ করে তারপর একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসুন। কান-চোখ-অন্তর এই তিন মাধ্যমের সুসমন্বিত প্রয়োগ আশা করি আপনাকে সঠিকতার শীর্ষচূড়ায় পৌঁছে দিবে। কারো ব্যাপারে ভুলধারণা পোষণ করা, কোন বিষয়ে ভুল বোঝা ইত্যাদি বিড়ম্বনা থেকেও মুক্তি পাবেন। এমন সুন্দর একটা নীতিমালা ও জীবন-দর্শন পাওয়ার তো স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহর প্রতি আমাদের শুকরিয়া আসার কথা। তাই না? মনে আছে তো আয়াতের শেষ কথাটা? যাতে করে/হতে পারে তোমরা শুকরগুজার বান্দা হবে।
বলেছিলাম, এই বিষয়টি বোঝার পর তৃতীয় আরেকটি বিষয় আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হবে। এবার আসুন সেই তৃতীয়র ঘরে প্রবেশ করি।
জ্ঞানার্জনের যে দুইটা মাধ্যমের কথা জানলাম, শোনা ও দেখা- এই দুইয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো শোনা। আরবীতে একটি কথা আছে। আলফাদ্বলু লিলমুতাকাদ্দিমি। শ্রেষ্ঠত্ব অগ্রগামীর। শোনা শ্রেষ্ঠ বলেই কুরআন তাকে অগ্রগামী করেছে। তার প্রাপ্য সম্মানটুকু তাকে দিয়েছে। কুরআনের প্রতিটি শব্দের অগ্রগামিতা বা পশ্চাতগামিতার ভেতরেও বিশাল বড় হেকমত থাকে। এর ভেতর দিয়েও বহু কথা না বলেও বলে দেওয়া হয়। শব্দের এই আগু-পিছু ঘটনাচক্রে উপস্থাপিত নয়। বরং একজন মহাপ্রজ্ঞাবান প্রভুর প্রজ্ঞার অন্যতম নিদর্শন এটি। প্রতিটি বাক্য এমন সুচারুরূপে সাজানোর ক্ষমতা কোন মানুষের নেই। কুরআন তো আর এমনিতেই বারবার তার ভাষাশৈলী ও উপস্থাপনার উৎকর্ষের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় না। চ্যালেঞ্জ থেকেই অনুমিত হয়, এর মধ্যে কুছ তো হ্যায়! চাই আমরা অনুধাবন-উদ্ঘাটন করতে পারি আর না পারি। তো যার যেই সম্পান পাওনা, তাকে সেটা নির্বিবাদে দিয়ে দেওয়ার শিক্ষাটা আমরা এখান থেকে নিতে পারি। যাইহোক, জ্ঞানার্জনের মাধ্যম হিসেবে শোনা কেন দেখা-পড়ার তুলনায় শ্রেষ্ঠ সেই কথাটাই এখন আরেকটু সবিস্তারে বলবো।
সকল জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু হলেন মহান আল্লাহ তাআলা। তিনি জ্ঞানীদেরও জ্ঞানী, মহাজ্ঞানী। তারচে বড় জ্ঞানী আর কেউ নাই। তিনি যখন জিবরীল আ. এর মাধ্যমে তার জ্ঞানের ছিটেফোঁটা বিতরণ করলেন তাঁর প্রিয়বান্দা ও রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে তখন তিনি শ্রবণ-মাধ্যমকেই ব্যবহার করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, জিবরীল আ. শুনেছেন। তারপর জিবরীল আ. নিজেও একই পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেছেন, নবী আলাইহিসসালাম শুনেছেন। নবী আলাইহিসসালামও একই পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেছেন, সাহাবীরা শুনেছেন। এই তিন ধাপ পার হবার পর জ্ঞানার্জনের দ্বিতীয় মাধ্যমের ব্যবহার আমরা পাই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবতীর্ণ ওহী সাহাবিদের প্রথমে শুনিয়েছেন, তারপর তাদেরকে তা লিখে রাখার আদেশ দিয়েছেন। সেই লিখিত কপি থেকে অন্যরা দেখে তা মুখস্ত করেছে। তো শিক্ষার্জনের ক্ষেত্রে দেখার ব্যাপারটার উপস্থিতি অনেক পরে এসেছে। দেখা ও পড়ার তুলনায় শ্রবণ যে শ্রেষ্ঠ মাধ্যম আশা করি তা বুঝতে আমাদের বেগ পেতে হয়নি।
এখন আমরা এই প্রসঙ্গে আরেকটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবো। প্রশ্নটি হলো, শোনা শ্রেষ্ঠ বলেই আল্লাহ তাআলা, জিবরীল আ. ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা গ্রহণ করেছেন। প্রথম তিন ধাপে লিখন-দেখন-পঠন পদ্ধতি পরিহার করা হয়েছে। এই শ্রবণ-পদ্ধতি শ্রেষ্ঠ কেন? তার আলাদা বৈশিষ্ট্য কী? দেরি না করে ঝটপট উত্তরটা জেনে নেওয়া যাক।
যে-কোন জ্ঞান সুচারুরূপে একজন থেকে আরেকজনের কাছে স্থানান্তরিত হওয়ার জন্য সবচে বেশি দরকার হয় দু’জনের কাছাকাছি হওয়া। একজন অপরজনের সামনাসামনি হওয়া। আত্মশুদ্ধির জন্য তাসাওউফশাস্ত্রে কিংবে বর্ণনার মাত্রা শক্তিশালী করার জন্য হাদীসশাস্ত্রে অধিককাল ধরে শায়খের সুহবত-সান্নিধ্যে থাকা বা হাল আমলের ডাক্তারিবিদ্যায় অভিজ্ঞ ডাক্তারের সাথে থেকে ইন্টার্নি করা এ-সবই একই সূত্রে গাঁথা। চোখ দিয়ে কিছু বইপত্র পড়ে ফেলার মূল্য এখানে কম। বরং গুরুর সান্নিধ্যে থেকে সামনে বসে সরাসরি শিক্ষা নেওয়াটা বেশি দামী।
জ্ঞানার্জনের এই পদ্ধতিই হলো নববী পদ্ধতির প্রথম ও শ্রেষ্ঠ ধাপ। তারপর হলো লেখা-দেখা-পড়ার ধাপ।
এই যুগে এসে আমরা অনেকেই জ্ঞানার্জনের জন্য শায়খের সান্নিধ্য গ্রহণ করা ও সরাসরি তাঁর সামনে বসে মুখ থেকে ইলম নেওয়াকে অতোটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না। এটি সম্পূর্ণই অজ্ঞতাপ্রসূত ভাবনা। বরং মুখ থেকে সরাসরি নসীহত গ্রহণ করার যে কার্যকারিতা রয়েছে, বইয়ের পাতায় তা কখনোও পাওয়া যাবে না। যদিও বই-ও স্বল্প পরিসিরে হলেও কিছু প্রভাব সৃষ্টি করে ব্যক্তির মনে।
আয়াতটির শেষভাগে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, হতে পারে তোমরা শুকরিয়া আদায় করবে। শুকরিয়ার কথাটা নিশ্চিতভাবে না বলে সন্দেহপূর্ণভাবে বলার কারণ হলো, এতো এতো নিয়ামত পাওয়ার পরও কিছু বান্দা আছে, যারা শুকরিয়া আদায় করবে না। মহামহিম রবকে ভুলে যাবে, ভুলে থাকবে। আরেকটু আগ বেড়ে কেউ কেউ তো তাকে অস্বীকারই করে বসবে। সবাই এই দানের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করবে না। যদিও আল্লাহ তাআলা আগে থেকেই জানেন কারা কৃতজ্ঞচিত্ত বান্দা হবে, কারা হবে না। সন্দেহপূর্ণভাবে বলা হয়েছে বান্দাদের জ্ঞানের দিকে লক্ষ্য করে।
© আবদুল্লাহ আল মাসউদ
Alhamdulillah,valo laglo